কাশ্মীরের করুণ কাহিনি: একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে নিঃস্ব পরিবার, পহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় নিহত আদিল শাহ ছিলেন সাহসী, সরল ও নিরীহ একজন কাশ্মীরি
২২ এপ্রিল ২০২৫
কাশ্মীরের সৌন্দর্য আর শান্তিপূর্ণ প্রকৃতির পটভূমিতে এক গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পর্যটনের প্রাণকেন্দ্র পহেলগামে গত মঙ্গলবার ঘটে যাওয়া বন্দুকধারীদের নারকীয় হামলায় যখন দেশজুড়ে নিন্দা ও শোক বইছে, তখন সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে হাপতনা গ্রামে। নিহতদের মধ্যে একমাত্র কাশ্মীরি ছিলেন সৈয়দ আদিল হুসেন শাহ—একজন সাধারণ ঘোড়সওয়ারি চালক, একজন দায়িত্বশীল পুত্র, একজন নিঃস্ব পিতা, এবং পরিবারের একমাত্র অবলম্বন।
হামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
মঙ্গলবার, জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাম থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে বৈসারণে এলাকায় কিছু অজ্ঞাত বন্দুকধারী পর্যটকবাহী গাড়িতে এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। ওই ঘটনায় কমপক্ষে ২৬ জন প্রাণ হারান। যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা নিরীহ পর্যটক।
তবে যে বিষয়টি মন ছুঁয়ে যায়, তা হলো—এই হামলায় একমাত্র কাশ্মীরি নিহত সৈয়দ আদিল হুসেন শাহ। তিনি সেই সময় পর্যটকদের ঘোড়ায় করে পহেলগাম ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন। জানা গেছে, বন্দুকধারীদের হামলা ঠেকাতে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিবাদ করেন, এমনকি একটি অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ারও চেষ্টা করেন। এর ফলেই হয়তো তিনি সন্ত্রাসীদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হন।
“আমার ছেলেটা আর নেই, আমাদেরও আর কিছু নেই” – কাঁদতে কাঁদতে বললেন মা
সৈয়দ আদিল হুসেন শাহের মৃত্যু যেন কেড়ে নিয়েছে তার পরিবারের সমস্ত আলো। পরিবারের সদস্যরা জানান, আদিল ছিলেন পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। মা, বাবা, স্ত্রী ও দুই ছোট ভাই তাঁর আয়ের উপরই নির্ভর করতেন। তাঁর সদ্য প্রয়াত একমাত্র ছেলেটির শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই, এবার তিনিই পরিণত হলেন স্মৃতিতে।
তার মা কান্নাভেজা কণ্ঠে বার্তা সংস্থা এএনআই-কে বলেন,
“বাড়ির সবচেয়ে বড় ছেলে ছিল, একমাত্র ও-ই উপার্জন করত। ওর মৃত্যু মানে আমাদের ভবিষ্যৎই শেষ হয়ে যাওয়া।”
ঘটনার দিন অসংখ্যবার ফোন করেও পাননি কোনো সাড়া
তার পিতা সৈয়দ হায়দার শাহ বলেন,
“ও ঘোড়া নিয়ে পহেলগামে গিয়েছিল। বেলা তিনটার দিকে খবর পাই যে ওখানে হামলা হয়েছে। ফোন করি, কিন্তু বন্ধ পাই। বিকেল ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে ফোন চালু হলেও কেউ ধরছিল না। পরে আমাদের ছেলেরা হাসপাতালে গিয়ে জানায়, আদিল আর নেই।”
এই পিতার চোখে এখন শুধুই দুঃখ, ক্ষোভ আর অসহায়তা।
“যার প্রাণ যাওয়ার ছিল, সে তো চলে গেছে। কিন্তু যারা এই কাজ করেছে, তাদের বিচার হোক—এইটাই চায় একজন পিতা।”
জানাজায় গ্রামের কান্না, পাশে দাঁড়ালেন মুখ্যমন্ত্রী
বুধবার সকালেই হাপতনা গ্রামের মাঠে জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। হাজারো গ্রামবাসীর পাশাপাশি সেখানে উপস্থিত ছিলেন জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ। তিনি নিহতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন, সান্ত্বনা দেন এবং সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তার আশ্বাস দেন।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন,
“এমন ঘটনায় কিছু বলার থাকে না। এই শোক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমরা এই কাপুরুষোচিত হামলার তীব্র নিন্দা জানাই এবং প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে রয়েছি।”
তিনি আরও জানান, নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। যদিও নিজেই স্বীকার করেন, “এই অর্থ কোনোভাবেই মানুষের জীবন ফেরত দিতে পারে না।”
গ্রামবাসীদের ক্ষোভ ও দাবি: ষড়যন্ত্র খুঁজে বের করুন
আদিলের আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা জানান, সে ছিল অত্যন্ত পরিশ্রমী, নম্র ও নিরীহ। তার কাকা বার্তা সংস্থাকে বলেন,
“ওর বাড়িতে আর কেউ নেই যে উপার্জন করতে পারে। ছেলেটা নির্দোষ ছিল, খুব দরিদ্র পরিবারের সন্তান। এই অবস্থায় সরকারকে তাদের পাশে দাঁড়াতেই হবে।”
আদিলের আত্মীয় মহিদিন শাহ বলেন,
“এটা একটা ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। আমাদের দাবি, এই ষড়যন্ত্র যেন উদ্ঘাটন করা হয় এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর না ঘটে।”
তিনি আরও বলেন,
“কাশ্মীর তো সবসময় অতিথিপরায়ণ। পর্যটকদের অভ্যর্থনা জানানোই আমাদের সংস্কৃতি। অথচ এমন এক নিরীহ গরিব ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হলো! এটা শুধু কলঙ্ক নয়, এটা কাশ্মীরের হৃদয়ে ছুরিকাঘাত।”
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও তীব্র
কাশ্মীরের পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির নেত্রী মেহবুবা মুফতি এই হামলার নিন্দা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লেখেন,
“পহেলগামে কাপুরুষোচিত সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। কাশ্মীর এমন বর্বরোচিত ঘটনার জায়গা নয়। ঐতিহাসিকভাবে আমরা শান্তিপূর্ণ ও অতিথিপরায়ণ ছিলাম। এই হামলা সেই ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে এক ঘৃণ্য আঘাত।”
শেষ কথা: এক সাহসীর বিদায়, এক পরিবারের ভবিষ্যতের অবসান
সৈয়দ আদিল হুসেন শাহের মৃত্যু যেন এক সাহসী, পরিশ্রমী এবং দায়িত্বশীল যুবকের মৃত্যুই নয়—এটি কাশ্মীরের গরিব মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামেরও একটি নির্মম প্রতিচ্ছবি। তার মৃত্যুর ফলে একটি পরিবার আর্থিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে।
প্রশাসনের উচিত এই পরিবারটির জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং যারা এই জঘন্য হামলা চালিয়েছে, তাদের দ্রুততম সময়ে আইনের আওতায় আনা।
কাশ্মীর তার এক গর্ব হারাল। আর হাপতনা গ্রাম হারাল এক সন্তান, এক আশ্রয়, এক অবলম্বন।