ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে রমজানকে স্বাগত জানাল গাজাবাসী
যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে রমজান
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় আবারও এসেছে পবিত্র মাহে রমজান। যখন গোটা বিশ্ব আনন্দঘন ও উৎসবমুখর পরিবেশে রমজান পালন করছে, তখন গাজার মানুষ শত দুঃখ-কষ্ট, ক্ষুধা ও অনিশ্চয়তার মাঝে পার করছে এই বরকতময় মাস।
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
গাজায় যুদ্ধের বিভীষিকা এখনো কাটেনি। যুদ্ধবিরতি চলছে বটে, তবে সেটি স্থায়ী হবে কি না—এ নিয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই। যে কোনো মুহূর্তে যুদ্ধ ফের শুরু হতে পারে। এই আতঙ্কে দিন কাটছে মানুষের। বিগত বছরের ভয়াবহ স্মৃতি এখনো দোলা দেয় মনে। গাজার মানুষ এখনো ট্রমার মধ্যে আছে, সেই ভয়াল দিনগুলো ভুলতে পারেনি।
অতীতের বিভীষিকা
শুধু ২০২৪ সালেই নয়, আগের বহু রমজানেও রাত কেটেছে বোমা হামলার আতঙ্কে। অনেক সময় সেহরি ও ইফতারের সময়ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়েছে। একটি শিশুর স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে, কীভাবে রোজার রাতে তাদের ওপর বোমা হামলা হয়েছিল। সেই স্মৃতি চিরদিনের জন্য মনে ভারী হয়ে আছে।
রমজানের কষ্ট
গত রমজান ছিল আরও ভয়াবহ। চারপাশের মানুষ অভুক্ত ছিল। অনেকের ঘরে সেহরির খাবারও ছিল না। সারাদিন রোজা রেখে একটি মটরশুটির পানীয় ক্যান ভাগ করে ছয়জন পান করেছিল। বিদ্যুৎহীন অন্ধকারে টেবিলের নিচে লুকিয়ে স্বাদহীন কিছু খাবার খেয়ে ইফতার করতে হয়েছিল।
পরিবার বিচ্ছিন্নতা
সেই সময় পরিবারের অধিকাংশ সদস্য বিচ্ছিন্ন ছিল। রমজান, যা সংযোগের মাস, তা তাদের জন্য হয়ে উঠেছিল বিচ্ছিন্নতার প্রতীক।
রমজানের শান্তি
রমজানে বিশেষ আনন্দ থাকে। সারাদিন উপবাসের পর মাগরিবের আযান শুনে ইফতারের যে শান্তি, সেটি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু যুদ্ধের সেই দিনগুলোতে তারা সেই মধুর ধ্বনি শোনেনি। অধিকাংশ মসজিদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। কেউ কেউ আযান দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভয় ছিল—আযানের শব্দ শুনে বিমান হামলা হতে পারে!
ইফতার ও তারাবির স্মৃতি
সেই সময় রোজা ভাঙতে হয়েছিল ক্ষেপণাস্ত্র ও গুলির শব্দ শুনে। যুদ্ধের আগে ইফতারের পর পরিবারের সঙ্গে মসজিদে যাওয়া, নামাজ পড়া, প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা করা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু গত রমজানে কোথায় তারাবির নামাজ পড়েছে, তা মনে রাখতে পারেনি অনেকে। কারণ ছিল শুধু ছুটে বেড়ানোর জীবন।
হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য
গাজার ঐতিহ্যবাহী গ্রেট ওমারি মসজিদটিও ধ্বংস হয়ে গেছে। রমজানের শেষ দশকে যেখানে অনেকেই ইতিকাফ করতেন, কুরআন পড়তেন, ইবাদতে সময় কাটাতেন, সেই প্রিয় মসজিদটিও আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতি
এবার রমজান শুরু হয়েছে যুদ্ধবিরতির মাঝে। আপাতত তেমন আতঙ্ক নেই। ইফতারের সময় ক্ষেপণাস্ত্রের শব্দ নেই, ফজরের নিরবতা ভাঙার মতো কোনো বিস্ফোরণও নেই। কিছু এলাকায় রঙিন বাতি জ্বলছে। কিছু দোকান খুলেছে, ধ্বংস না হওয়া মার্কেটগুলো চালু হয়েছে। গাজার রাস্তায় আবারও রমজানের ছোঁয়া ফিরতে শুরু করেছে।
অপূরণীয় ক্ষতি
তবু, এই রমজানে ৪৮ হাজারের বেশি প্রাণহানির স্মৃতি ভোলা সম্ভব নয়। অনেক পরিবার হয়তো সবাইকেই হারিয়েছে। ইফতার টেবিলে বসে কেউ বাবাকে খুঁজবে, কেউ একমাত্র সন্তানের অনুপস্থিতি অনুভব করবে। কোনো সন্তান যে মায়ের হাতে ইফতার করত, সে হয়তো এবার সেই মাকেও হারিয়েছে।
হারানোর বেদনা
অনেকেই আপনজনদের হারিয়েছে। কেউ প্রিয়জনকে হারিয়েছে, যে প্রতি রমজানে দাওয়াত করত। কেউ হারিয়েছে প্রিয় বন্ধুকে, যার সঙ্গে প্রতি রমজানে আড্ডা দেওয়া হতো।
ঈমানের দৃঢ়তা
হ্যাঁ, রমজান এসেছে ঠিকই। কিন্তু সেই উৎসবমুখর পরিবেশ নেই। আছে কেবল বেঁচে থাকার লড়াই, আছে হারানোর বেদনা।
আল্লাহর রহমতের আশায়
রমজান রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। এখনই সময় মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া, তাঁর সান্নিধ্য লাভ করা, আধ্যাত্মিকভাবে আরও বেশি সংযুক্ত হওয়ার।
ওরা আমাদের মসজিদ ধ্বংস করতে পেরেছে, ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের ঈমানকে একটুও নড়াতে পারেনি। আজও গাজার মানুষ ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে তাবু গেড়ে তারাবির নামাজ পড়ছে, কুরআন তিলাওয়াত করছে। প্রভুর কাছে দু’হাত তুলে দোয়া করছে—এই কষ্টের শেষ হোক, শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করুক। তারা বিশ্বাস করে, মহান আল্লাহ তাদের ধৈর্যের উত্তম প্রতিদান দেবেন।