পরিপ্রেক্ষিত: বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির সূচনা
১৯৭২ সালের ১৭ই মার্চ, মাত্র তিন মাস আগে স্বাধীনতা অর্জন করা বাংলাদেশে পা রাখেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কোনো বিদেশি সরকার প্রধানের রাষ্ট্রীয় সফর। তেজগাঁও বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, এবং দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়।
তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরের সময় দুই দেশের সরকারপ্রধানদের মধ্যে আলোচনার পর ১৯শে মার্চ স্বাক্ষরিত হয় ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি’। এই ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তিটি দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্পর্ক জোরদার করার প্রতিশ্রুতি বহন করলেও, চুক্তি স্বাক্ষরের পর তা নিয়ে তুমুল রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
চুক্তির মূল বিষয়বস্তু
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির প্রধান দিকগুলো ছিল:
- বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সহযোগিতা বৃদ্ধি।
- দুই দেশের জনগণের পারস্পরিক বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করা।
- সামরিক হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ করা।
- দুই দেশ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক ইস্যুতে একে অপরকে সমর্থন করবে।
বিতর্কের সূত্রপাত
যদিও চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা, তবে বিরোধী দলগুলো এটিকে ‘গোলামী চুক্তি’ হিসেবে আখ্যা দেয়। তাদের প্রধান অভিযোগ ছিল:
- চুক্তিটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
- ভারতীয় প্রভাবের কারণে বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।
- চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিশেষ করে, চুক্তির দীর্ঘ ২৫ বছর মেয়াদ নিয়েও সমালোচনা উঠে। অনেকেই মনে করেছিলেন, এত দীর্ঘ সময়ের জন্য এমন একটি চুক্তি বাংলাদেশকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে।
ইন্দিরা গান্ধীর সফর ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
ইন্দিরা গান্ধীর ঢাকা সফর কেবল চুক্তির জন্যই নয়, সামগ্রিকভাবে দুই দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সফরের সময় বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে উচ্ছ্বাস থাকলেও রাজনৈতিক মহলে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
বিশেষ করে, ১৭ই মার্চ সরকারি ছুটির ঘোষণার পর অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। দিনটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনও। কিন্তু শেখ মুজিব স্পষ্টভাবে জানান, ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল শুধুমাত্র ইন্দিরা গান্ধীর আগমনের কারণে।
উপসংহার
মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি একদিকে যেমন দুই দেশের বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, অন্যদিকে এটি রাজনৈতিক মহলে উত্তপ্ত বিতর্কের জন্ম দেয়। সময়ের সাথে সাথে এই চুক্তি নিয়ে বিতর্ক কমে এলেও, এটি এখনও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভিত্তি তৈরিতে এই চুক্তির ভূমিকা অপরিসীম, তবে সমালোচকদের চোখে এটি ছিল সার্বভৌমত্বের প্রশ্নবিদ্ধ অধ্যায়।